Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বেতাগী ইউনিয়নের ইতিহাস

বেতাগী ইউনিয়ন চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফূলী নদীর উজানে প্রায় ১২ মাইল কিংবা কালূর ঘাট পুল থেকে একই নদীপথে প্রায় ৬মাইল যাবার পর নদী যেখানে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি জন্য সুপরিচিত কুশল্যা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে সেখানে উপব্দীপকার যে ভূখন্ড সেটি হচ্ছে বেতাগী। অথবা চট্টগ্রাম শহর থেকে এশিয়ান হাইওয়ে এবং তার পরে কাপ্তাই সড়ক ধরে যেতে যেতে সড়কটি যেখানে প্রথম পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করেছে সেখানে পাহাড়তলী চৌমুহনী থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে প্রায় তিন মাইল গিয়ে কর্ণফুলী নদীতীরে পাবেন বেতাগী। কাপ্তাই সড়ক ধরে পাহাড়তলী চৌমুহনী থেকে আরো প্রায় দুই মাইল গিয়ে শান্তির হাট থেকে ডান দিকে মোড় নিয়েও বেতাগী যাওয়া চলে। শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম ঋতুর শান্ত নদী কর্ণফূলীর ধীর প্রবাহিত স্রোতধারায় চাঁদনি রাতে চন্দ্রালোকের প্রতিবিম্ব দুলিয়ে মাল্লাদের ভটিয়ালী গানের সুর যেমন গ্রামীণ জনজীবনে মৃদু স্পন্দন জাগায় তেমনি আবার ঘোর বর্ষায় বেগবতী কর্ণফুলী রুদ্ররুপ গ্রামবাসীর মনে সৃষ্টি করে প্রচন্ড ত্রাস। এই দুই ঋতুতে কর্ণফুলী নদীর দুই পরস্পরবিরোধী রুপ বেতাগী এলাকতেই বেশী পরিস্ফুট এবং বেতাগীবাসীর চিরপরিচিত। বেতাগীর দক্ষিণ উপকূলে যেখানে গোলাম বেপারী হাট অবস্থিত সেখানেই নদীটি বেশী প্রশস্থ এবং হাটটি ও তার পার্শ্ববর্তী নদীতীর হয় বর্ষায় রুদ্ররুপিনী কর্ণফুলীর নিষ্ঠুর শিকার। গ্রামের নাম বেতাগী হবার কোনো প্রামান্য ঐতিহাসিক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। কিংবদন্তী অনুসারে উপদ্বীপ সদৃশ জনপদটির প্রায় মধ্যাঞ্চল দিয়ে বেতের আগার মতো সর্পিল গতিতে প্রবাহিত বেতাগী খালের উভয় তীরে ঘন বেতবনের নামানুসারে গ্রামের নাম হয়েছে ‘বেতাগি’ (বেতের অগ্রভাগ) অর্থাৎ বেতাগী। নাম প্রসঙ্গে দুই বেহাই-এর মধ্যে একটি রসিকতা গল্পও শোনা যায়। ভিন্ন গ্রাম থেকে বেতাগীর বেহাই বাড়ীতে আগত বেহাই নাকি বলেছিলেন, “বেতাগীর মানুষ বে-ত্যাগী” অর্থাৎ ত্যাগ করতে জানেনা। তাই গ্রামের নাম হয়েছে বে-ত্যাগী অর্থাৎ বেতাগী। জবাবে বেতাগীর বেহাই নাকি বলেছিলেন, “আরে না না, এখানে ব্যথার ঘি অর্থাৎ ব্যথা উপশমের ঘি পাওয়া যেতো বলে গ্রামের নাম হয় ব্যথার ঘি অর্থাৎ বেতাগী। দুই বেহাই এর মধ্যে নিছক একটি রসিকতার গল্প ছাড়া কিছু নয়। তবে একটি কৌতূহলের বিষয় হচেছ যে বাংলাদেশের বরিশাল, কুষ্টিয়া, পাবনা প্রভৃতি জিলাতেও বেতাগী নামের থানা কিংবা গ্রামের অস্তিত্ব মেলে। একইভাবে আমাদের বেতাগী ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত কাউখালী গ্রামের একই স্থানও অন্য জিলার মানচিত্রে দেখা যায়। এই মিলের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা পন্ডিতগণের গবেষনার বিষয়। বেতাগী ইউনিয়নের উত্তরে পাহাড়তলী ইউনিয়ন ও পোমরা ইউনিয়ন, পূর্বে ও দক্ষিণে কর্ণফূলী নদী। এবং পশ্চিমে বাগোয়ান ইউনিয়ন। পূর্বতন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জিলাদ্বয়ের প্রায় মাঝখানে রাউজান-রাঙ্গুনিয়া-বোয়ালখালী এই তিন থানার সঙ্গমস্থলে রাঙ্গুনিয়া থানার অন্তবর্তী হচ্ছে বেতাগী ইউনিয়ন। এখানে বেতাগী (৬মৌজা),ঢেমিরছড়া, আন্দরঘোনা, বানিয়া খোলা, ডিঙ্গললোঙ্গা (২ মৌজা), তিনচৌদিয়া, চেংখালী (২ মৌজা), কাউখালী ও গুনগুনিয়া বেতাগী এই ১৬টি মৌজা রয়েছে। তন্মধ্যে নদী তীরবর্তী বেতাগীর ৫ মৌজা এবং কাউখালী ও গুনগুনিয়া বেতাগী বাদ দিলে অবশিষ্ট মৌজাগুলো পাহাড়ময়। মোটামুটিভাবে সমগ্র বেতাগী ইউনিয়নের অর্ধাংশ সমতল ভূমি্ এবং বাকি অর্ধাংশ অসংখ্য ‘ঘোনা’ ও ‘থলি’ (উপত্যকা) খচিত পাহাড়ী ভূমি। বিভিন্ন পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে কতগুলো ছড়া ও খাল। ছড়াগুলো বর্ষাকালে পানিপূর্ণ থাকলেও শুকনো মৌসুমে শুষ্ক বালূকাময়। কর্ণফূলী-বিধৌত সমতল ভূমি, উঁচুনীচু পাহাড় ওটিলার বনজঙ্গল, ছড়া, ও খাল, সবুজ উপত্যকা আর গভীর নীলাকাশ মিলে বেতাগী ইউনিয়নের নিসর্গ শোভাকে করেছে এতই মনোরম যে আরব্যরজনীর কাহিনীর মতোই একজন আরব বাদশা এখানকার পাহাড়ে নিমার্ণ করছেন তার বিনোদনের জন্য একটি সুরম্য উদ্যান-অট্টালিকা। বেতাগী ইউনিয়নে লোকসংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার। তন্মধ্যে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মুসলিম, ২০ ভাগ হিন্দু এবং ১০ ভাগ বৌদ্ধ। অধিকাংশ গ্রামবাসীই কৃষি কিংবা শ্রমজীবি, বাকি ব্যবসায়ী ও চাকুরীজীবি এবং প্রবাসী। সমগ্র ইউনিয়নের সাক্ষরতার হার বাংলাদেশের জাতীয় গড় হারের সমতূল্য। বেতাগী এলাকা কত প্রাচীন তা জানবার মতো ঐতিহাসিক তথ্য এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ইউনিয়নের চম্পাতলী এলাকার আশেপাশের ভূগর্ভে কিছু পুরাকীর্তির নিদর্শন পাওয়া গেছে। এলাকাটির দক্ষিণাংশে পাহাড়ের ঢালে মাটির নীচে ১৯৫৬ সালের জানুয়ারী মাসে ১০×৭×২ ইঞ্চি মাপের মধ্যযুগীয় ইটের গাঁখুনিযুক্ত একটি পাতকুয়া আবিস্কৃত হয়। সেই পাতকুয়ায় নাকি পিতল নির্মিত একটি প্রাচীন ছোট বুদ্ধমূর্তিও পাওয়া গিয়েছিলো। পশ্চিম দিকে খোন্দকার বাগিচা নামক কবরস্থানের পাহাড়টিতে কবর খননের সময়ে মাঝে মাঝে একই মাপের প্রাচীন ইস্টক নির্মিত দেওয়ালের নিদর্শন পাওয়া যায়। পাহাড়টির দক্ষিন দিকে নীচে বর্তমানে বিলূপ্ত হলদ্যা পুকুরের পাড় থেকে মাটি খনন করে ডেকচি পূর্ণ স্বর্ণমুদ্রা আবিষ্কারের জনরবও শোনা গেছে। এই সমস্ত বাস্তব তথ্য ও জনরব থেকে অনুমান করা হয়ে যে, কয়েক শতাব্দী আগে এলাকাটিতে ধনশালী আরাকানী বৌদ্ধদের বসতি ছিলো। তাছাড়া মধ্য বেতাগীর গাবগুলাতল থেকে মালেকার বাপের বাড়ীর সামনের জগন্নাথ পুকুরের পশ্চিম পাড় পর্যন্ত ইটের গাঁথুনিযুক্ত রাস্তায়, গোলাম আলী চৌধুরীর নির্মিত মসজিদের সিমেন্ট বিহীন পাকা দেওয়ালে, জান আালী ইজারাদের তেরজুরী (treasury সরকারী কোষাগার) –র ভগ্নাংবশেষে, ধামাই পুল ও গোলাম আলী চৌধুরী সড়ক (বেপারীর জাঙ্গাল) এর ২টি নাশিতে ৬.৫×৩×২.৫ ইঞ্চি মাপের অনেক ইট দেখতে পাওয়া গেছে। অর্থাৎে এই সমস্ত ইট মধ্যযুগীয় স্থাপত্যে ব্যবহৃত ছিলো বলে এই সমস্ত স্থাপনাকে মনে করা হয় মধ্যযুগীয় পুরাকীর্তির নিদর্শন। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানের নামেও পাওয়া যায় মোগল, আরাকানী, ত্রিপুরা, প্রভৃতি আমলের নামের ইঙ্গিত। যেমন, বদরের দীঘি, নঈয়ারখিল, খাজাঞ্চীর দীঘি, লাওসি পুকুর, পরাণগোমস্তা পুকুর, বিষকরমের পুকুর, বেপারীর জাঙ্গাল, মির্জারখীল প্রর্ভতি নামোল্লেখ করা যায়। বেপারীর জাঙ্গালের উত্তর ধারে পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে মহাকাশের সাক্ষীরুপে দন্ডায়মান সুবিস্তৃত ডালপালা শোভিত বটবৃক্ষটি নাকি ২০০ বৎসরের ও বেশী প্রাচীন। আমাদের পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের লোককে বলতে শুনেছি তারা শৈশব থেকে বটবৃক্ষটিকে একই অবস্থায় একই আকারে দেখেছেন। জাপানে নাকি এরুপ প্রাচীন গাছকে জাতীয় রত্মরুপে সংরক্ষণ করা হয় সরকারী উদ্যোগে। এই বটগাছটিকেও জাতীয় ঐতিহ্যর সাক্ষীরুপে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়অ উচিত বলে আমরা মনে করি। কিংবদন্তী আছে যে, এই বটগাছটিরই পাশে ছিলো আরেকটি বিরাট বটগাছ যাকে বলা হতো “আটকড়ি”র বটগাছ। এই বটবৃক্ষ তলে নাকি ছিলো ফেরীঘাট যেখান থেকে সেকালেরমুদ্রায় আটটি কড়ি দিয়ে হাটহাজারী থানায় ফতেয়াবাদের “ঝরঝরি” বটতল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ দরিয়া পারাপার করা হতো। তাই বটগাছটির নাম হয় আটকড়ির বটগাছ। এমন কিংবদন্তীও আছে যে এই বটতলা থেকে ফেরী নৌকা দেয়াঙের পাহাড়েও যাতায়াত করতো। এই সমস্ত কিংবদন্তী থেকে অনুমান করা হয় যে এককালে কর্ণফূলী নদীর দক্ষিণে খরণদ্বীপ, চরণদ্বীপ, তৈলাদ্বীপ, হাবিলাইসদ্বীপ, ধলঘাট প্রভৃতি স্থানের নাম একটি সুবিস্তৃত দরিয়ার অস্থিত্বের কাহিনীকেই সমর্থনকরে নাকি? প্রায় ২০০ বছর আগে বেতাগীতে কিছু বিদ্বান ও পন্ডিতব্যক্তির বসতি ছিলো। তাদের অন্যমত একজন হচ্ছেন মদন-পন্ডিত যিনি “ছোটঠাকুর” নামেই বেশী পরিচিত। শোনা যায় আরাকানী রাজসভার একজন সভাপন্ডিতের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, যোগাযোগ ও আনাগোনা ছিলো। মদন-পন্ডিত কৃষিকার্য করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একবার কৃষি মৌসুমে আরাকানী রাজসভার পন্ডিত বেতাগীর মদন-পন্ডিতের সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখতে পান মদন পন্ডিত যালাক্ষেতে থেকে একান্ত মনে যালা তুলছেন। সারাদেহ জলাকাদায় একাকার। তাঁর এই কিম্ভূতকিমাকার মূর্তিটি দেখে আরাকানী পন্ডিত ছড়া কেটে বলেছিলেন- “এ্যাকি মদন ভেরকেডি বদন যালা হারিতে পারে! পূর্বে আছিলো মদন লক্ষী বদন, যমে হরি নিলো তারে।” অর্থাৎ ধানের চারা তোলার অবস্থায় কাদামাখা মদন-পন্ডিতের কি যে কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি! আগে যে সুন্দর দেহটি ছিলো, যম সেই সুন্দর চেহারা হরণ করে নিয়ে গেছে। তাই এই অবস্থা। (সংগৃহীত) (মোহাম্মদ আবুল হায়াত চৌধুরী ও ইসকান্দার আহমদ চৌধুরী কর্তৃক লিখিত বই “শ্যামল মাটির ধরাতলে” এর অংশ বিশেষ। আমি মোহাম্মদ মামুন উদ্দীন। পিতা- মোহাম্মদ মিয়া, গ্রাম- মধ্য বেতাগী। লিখায় কোন ভূল থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন) আল্লাহ তালা বেতাগীর মানুষদের সবাইকে মিলে মিশে থাকার তৌফিক দান করুক। আমিন। বাংলাদেশ চিরজীবি হোক। …………. আল্লাহ হাফেজ।